রবিবার, ২ আগস্ট, ২০২০

হুমায়ুন আজাদ - আহমদ ছফা দ্বন্দ্ব

হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফা-র দ্বন্দ্ব বাংলা সাহিত্যেপ্রেমিদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর একটি অধ্যায়। তারপরও ইতিহাস, ইতিহাস। দ্বন্দ্বের  প্রকাশ্য রূপের শুরু হুমায়ুন আজাদের মানবজমিনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার থেকে। যার প্রতিক্রিয়া ও পালটা প্রতিক্রিয়া বেশ আলোচিত হয়েছিল সেই সময়।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন 'রাজু আলাউদ্দিন'।

সাক্ষাৎকারটির পুনঃমুদ্রিত হয়েছে পাঠক সমাবেশ থেকে আলাপচারিতা নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থের শেষে সেই সময়ের যে পাঠ প্রতিক্রিয়া ছিল তাও মুদ্রিত আছে। আগ্রহী পাঠক আশা রাখি বইটি সংগ্রহে রাখবেন।

*** সাক্ষাৎকারটি এখানে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য যেন সকলে ইন্টারনেটে খুজে পায় এবং পড়তে পারে, আমি কোথাও এটি খুজে পাই নি। যদিও কপিরাইট আইনের মারপ্যাচ থাকতে পারে। আশা রাখি প্রকাশক এবং সংকলক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আলাপ চারিতা
রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক সাক্ষাৎকার
রাজু আলাউদ্দিন
পাঠক সমাবেশ
মুদ্রিত মূল্য-৯৯৫/- (২০১২)



আমাদের কত বিকারগ্রস্থ, কত উন্মাদ প্রতিভা হয়ে বসে আছে


*************************************************


রাজু আলাউদ্দিন : আপনার ইন্টারভিউ নিতে এসেই মনে পড়ল একসময় আপনি অনেকের ইন্টারভিউ নিয়েছেন।

হুমায়ুন আজাদ : অনেকের নয়, আমি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম সম্ভবত চারজনের।

রাজু : আপনি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন শওকত ওসমান, আবদুর রাজ্জাক আহমদ শরীফ...

হুমায়ুন আজাদ : শামসুর রাহমান।

রাজু : এখন তো আপনি নিজেই ইন্টারভিউ দেওয়ার পর্যায়ে চলে গেছেন।

হুমায়ুন আজাদ : পর্যায়ে চলে গেছি মানে কী, আমি বাংলাদেশে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমি যে সাক্ষাৎকারগুলো নিয়েছিলাম তার প্রতিটির পিছনে একটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো, কারো কারো সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছিলো না এবং আমারও তখন এ দেশের তুচ্ছ ক্ষুদ্রাকার সাক্ষাৎকার দেখে বিরক্তি ধরে গেলো। যেমন বিচিত্রা আমাকে অনুরোধ করলো যে আহমদ শরীফের একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকার তারা প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু বিষয় যে কী হবে তারা তা বুঝতে পারছে না। সাধারণত যারা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তারা তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তখন আমি তার একটি অতি বিস্তৃত, সম্ভবত এদেশে প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তারপর রফিক আজাদ আমাকে বললো, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের একটি সাক্ষাৎ ছাপতে চায় এবং আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আমি তাঁর সঙ্গে দাবা খেলেছি। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শিষ্য রয়েছে যারা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপে এবং পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। কিন্তু আমি গেলে- আমার বয়স যদিও কম তিনি দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দেন এবং আমি তার সঙ্গে সম-আসনে বসেই কথা বলেছি। আমি তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। যদিও রাজ্জাক সাহেবকে আমি অত্যন্ত সাধারণ একজন ব্যক্তি বলেই মনে করি। তাঁর জ্ঞানেও আমি মুগ্ধ নই, তাঁর খেলায়ও মুগ্ধ ছিলাম না। দাবা আমি খেলেছি এবং আমি নিয়মিত তাঁকে হারাতাম। তাকে কেন, আমি অনেককেই নিয়মিত হারাতাম। এমনকি নিয়াজ মোর্শেদকেও আমি হারিয়েছি। আমাদের ক্লাবে একজনের কাছে নিয়াজ মোর্শেদ হেরেছে এবং সে আমি ।

রাজু : তাই নাকি?

হুমায়ুন আজাদ : হ্যাঁ। আমি তারপর দাবা ছেড়ে দিয়েছি। দাবা মানুষকে নিঃশেষ করে ফেলে। যে নিয়মিত দাবা খেলবে তার সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। এটি অত্যন্ত মরণখেলা। তাছাড়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের চিন্তা-ভাবনা কখনোই আমার কাছে গভীর মনে হয়নি। তিনিও মনে করেন যে তাঁর চিন্তা-ভাবনা গভীর নয়। তিনি কিছু দুর্লভ গ্রন্থ পাঠ করেছেন যেগুলো সাধারণত পাওয়া যায় না। রাজ্জাক সাহেবের সাথে এদেশের বড় বড় লোকেরা কথা বলতে সাহস করে না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনি কখনো নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন কিনা, তিনি যেহেতু চিরকুমার। তারপর শামসুর রাহমানের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারে শামসুর রাহমানকে অনেকটা হাতুড়ি পিটিয়ে পিটিয়ে আমি তাঁর উত্তর বের করেছি, কারণ শামসুর রাহমান স্পষ্ট কথা বলতে ভয় পায়।

রাজু : তার উত্তরগুলো আপনি লিখে দেননি তো, স্যার?

হুমায়ুন আজাদ : না। হাঃ হাঃ। কিন্তু আমি পিটিয়ে পিটিয়ে অনেক কথা বের করেছি। পরে আমাকে আরও কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিতে অনুরোধ করেছিলো কয়েকটি পত্রিকা। আমি বলেছিলাম বরং তারাই এসে আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে যাক।

রাজু : স্যার, ইদানীং কী লিখছেন?

হুমায়ুন আজাদ : একটি উপন্যাস লিখে শেষ করেছি কয়েকদিন আগে। এখন আমি অর্থবিজ্ঞান সম্পর্কে একটি ছোট্ট বই লিখছি। এটা খুব বড় কাজ নয়, সময় কাটানোর জন্য আমি এটা করছি।

রাজু : ছোট্ট কাজও করেন?

হুমায়ুন আজাদ : ছোট কাজ এই অর্থে যে বাংলা ভাষায় তো অর্থবিজ্ঞানের চর্চা হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের কোন মৌলিক তত্ত্ব নেই। এ বইটি হবে মোটামুটিভাবে অর্থবিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেবার জন্য। অবশ্য কয়েক মাস ধরে উপন্যাস লিখছিলাম, গত মাসে শেষ হয়েছে এবং শেষ পৃষ্ঠাটি আমাকেই যন্ত্রণা দিয়েছে।

রাজু : কেন, স্যার?

হুমায়ুন আজাদ : উপন্যাসের নাম হচ্ছে ‘কবি অথবা দণ্ডিত অথবা দণ্ডিত অপুরুষ'। এর নায়ক হচ্ছেন একজন আধুনিক কবি এবং নাস্তিক। গভীর যন্ত্রণার মধ্যে শেষ হয়েছে। ট্রাজেডি বলাও বোধহয় সামান্য বলা হবে।

রাজু : সুপার ট্রাজেডি বলবো কি?

হুমায়ুন আজাদ : বলা যায় ভয়াবহ ট্রাজেডি।

রাজু : আপনার লেখা পড়ে দেখলাম আপনি কতগুলো শব্দ উপর্যুপরি ব্যবহার করেন, যেমন ‘মহা' এবং শোচনীয়। এটা কি আপনি সচেতনভাবেই করেন নাকি এমনিই চলে আসে?

হুমায়ুন আজাদ : না, ‘মহা' বোধ হয় আমি খুব বেশি ব্যবহার করি না।

রাজু : কিন্তু আপনার অবিশ্বাস এ আছে প্রচুর জায়গায়….

হুমায়ুন আজাদ : যেখানে প্রয়োজন হয়... সেখানে আমি মহা বিশেষণ ব্যবহার করি। যেখানে ‘অপ’ দরকার হয় সেখানে ‘অপ' ব্যবহার করি।

রাজু : যেমন ‘অপন্যাস ।

হুমায়ুন আজাদ : কাজেই বিশেষণ যখন আমি ব্যবহার করি সেখানে আমি ভেবে-চিন্তেই ব্যবহার করি। কোন আবেগবশত নয়।

রাজু : ছফা ভাইও আপনার মতই ‘মহা' শব্দটা ব্যবহার করেন। তিনি কয়েকদিন আগে আপনার সম্পর্কে একটা মজার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে হুমায়ুন আজাদের মতো মহারাজ জন্ম হবে এদেশে। সজারু যেমন মাতৃগর্ভ থেকে কাঁটা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার আত্মরক্ষার জন্য কারুর প্রয়োজন হয় না, তাতেই যথেষ্ট, হুমায়ুন আজাদ হচ্ছেন স্বয়ম্ভু। আপনার সম্পর্কে চমৎকার কমপ্লিমেন্ট।

হুমায়ুন আজাদ : ছফার মতো বিকারগ্রস্ত তুচ্ছ একজন লেখককে নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই।

রাজু : আপনি কি তাঁর কোন কাজকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না?

হুমায়ুন আজাদ : তিনি হচ্ছেন অত্যন্ত গৌণ একজন লেখক; আলোচনার যোগ্য নয়।

রাজু : আপনি হয়তো তাঁকে আলোচনার যোগ্য মনে করছেন না কিন্তু তিনি আমাদের দেশে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন।

হুমায়ুন আজাদ : তাঁর লেখা আলোচনার যোগ্য নয়। ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত হতে পারেন। আমাদের এখানে মূল্যায়ন নেই কাজেই এতো তুচ্ছ গৌণকে নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না।

রাজু : তাহলে স্যার, আপনার কবিতা সম্পর্কে আলোচনা হোক। আমি অবশ্য আপনার কবিতা পছন্দ করি। অনেকে আপনার কবিতার চেয়ে গদ্যকর্মকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আমি মনে করি আপনার কবিতাও একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হচ্ছেন আমাদের একমাত্র ‘হতাশাকরোজ্জ্বল' কবি।

হুমায়ুন আজাদ : আমার কবিতার তো মূল্যায়ন হয়নি। কারণ এতো বিপুল পরিমাণ গদ্য লিখেছি যে সে তুলনায় আমার কবিতার পরিমাণ কম। এটা গরিব দেশ; এখানে প্রাচুর্য চোখে পড়ে। আমার কবিতার দিকে খুবই কম দৃষ্টি পড়েছে। যারা চোখ দিয়েছে ভালো করে তারা জানে যে আমার থেকে ভালো কবিতা খুব বেশি কেউ লেখেনি। আমি সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে একটি পত্রিকা পেলাম তাতে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে যে আমিই হচ্ছি ষাটের দশকে সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান কবি। যে লিখেছে তাকে আমি কখনো দেখিনি, তার নামও জানতাম না, ফলে এটা আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে এবং বিস্মিতও করেছে।

রাজু : আপনার একটা কবিতা আছে 'উম্মাদ এবং অন্ধরা' নামে। লিখেছেন, ‘হুমায়ুন আজাদ, হতাশ ব্যর্থ শ্রান্ত অন্ধকারমুখী’, শেষ পঙক্তিটি হচ্ছে ‘এ আঁধারে উন্মাদ ও অন্ধরাই শুধু আশাবাদী।’

হুমায়ুন আজাদ : কবিতাটি ছোট, বলা যেতে পারে কবিতাটিতে দুজন কথক আছে। একজন হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে বলছে আর অন্যজন তার জবাব দিচ্ছে। বিশ্ব খুব আশা করার। খুব বেশি সুখের সাগরে ভাসার জায়গা নয়। এটি এমন কোন অভিনব ভাবনা নয়। বহুকাল ধরেই বহু লেখক, বহু কবি গভীর হতাশা .

রাজু : চর্চা করেছে?

হুমায়ুন আজাদ : চর্চা নয়, ব্যক্ত করেছে। আরেকটি কথা মনে রাখা ভালো; আশা কিন্তু খুবই তুচ্ছ ও স্থূল একটা ব্যাপার। এই আশাবাদীরা খুবই অগভীর, খুবই স্থল মানুষ, তারা সামান্য কিছু দেখেই প্রবল আশা পোষণ করে। আর যারা নিরাশাবাদী বা সরল বাংলায হতাশাবাদী় তারা গভীরতম আশা পোষণ করে বলেই এক রকম নিরাশার কথা বলে। তাঁদের আশা এতো বিপুল এতো অসীম যে তা চরিতার্থ হওয়ার নয়। কাজেই নিরাশার কথা বলতেই হয়। যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি ছোট্ট পঙক্তি আছে যেখানে বলছে, একটি ছোট্ট শিশির বিন্দু নিয়ে যদি ভাবি তাহলে ওটি গভীর অশ্রুর কারণ হতে পারে। আমরা স্থূলভাবে জীবনযাপন করি বলে অনেক কিছুই বুঝতে পারি না। নইলে এই মুহূর্তে যে জীবনযাপন করছি তা এতই নিরর্থক যে ভালো করে ভাবলে আমাদের এখন ব্যাপকভাবে হাহাকার করা উচিত।

রাজু : আপনি বাঙালি জাতি সম্পর্কে গভীরভাবে আশাবাদী বলেই তাদের এতো নিন্দা করেন?

হুমায়ুন আজাদ : বাঙালি সম্পর্কে না, বাঙালি আমার নিজের গোত্র এবং নিজের গোত্রকে আমি যতটা বিকশিত এবং যতটা মননশীল, সৃষ্টিশীল, সৎ, কর্মপরায়ণ দেখতে চাই, তারা তা নয়। কিন্তু আমি শুধু বাঙালির কথা ভাবি না, আমি মানুষের কথাই সাধারণভাবে ভাবি। আর বাঙালিকে আক্রমণ করার আমার বিশেষ অধিকার রয়েছে। আমি তো অন্য জাতির কাউকে আক্রমণ করি না। আমার নিজের গোত্রকে আক্রমণ করা অনেকটা নিজেকে আক্রমণ করাও।

রাজু : কিন্তু এই গোত্র সম্পর্কে আপনি যে হতাশার কথা বলেন...

হুমায়ুন আজাদ : অসীম হতাশার কথা আছে। এই গোত্রকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। গত এক হাজার বছরে বাঙালি এমন কোন অসামান্য কাজ করেনি যা নিয়ে আমরা খুব আশা পোষণ করতে পারি। বাঙালি কোন কিছু হলেই সামান্য পেলেই গর্বে ফেটে পড়তে চায়, আমি তা করি না। বাঙালি দর্শন, বিজ্ঞান, এমনকি সাহিত্য এবং অন্যান্য যত এলাকা আছে, কোথাও কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে নি। তোমার হাতের সেটটি বাঙালির আবিষ্কার নয়, টেলিফোন বাঙালির নয়, এখানে অনেকগুলো কলম রয়েছে এসব বাঙালির নয়। এমনকি তুমি যদি টয়লেটে যাও, দেখবে সেখানে যে বস্তুগুলো রয়েছে সেগুলো বাঙালি উদ্ভাবন করেনি। আর কম্পিউটার ও অন্যান্য বস্তুর কথা ছেড়েই দিই। আর সাহিত্য? বাঙালি নিজেকে নিয়ে অতিশয়োক্তি করে থাকে। বাঙালির সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের পাশে একটি আঞ্চলিক সাহিত্য মাত্র। আমাদের প্রধান লেখকরাও বিশ্বের দ্বিতীয় মাপের লেখক। আমাদের সৃষ্টিশীল লেখকেরা তবু গণ্য হতে পারে। বাঙালির কোন মননশীলতা নেই। আমি সেই আগের মধ্যযুগ ও আদিযুগ ছেড়েই দিলাম। ঊনিশ শতক থেকে যে মননশীলতার চর্চা হচ্ছে তা হচ্ছে পশ্চিমের মানদণ্ডে অত্যান্ত সামান্য। মোটামুটি বলা যেতে পারে যে আমাদের ঊনিশ শতক থেকে যে মননশীলতার চর্চা হচ্ছে তা হচ্ছে পশ্চিমের চিন্তা ভুলভাবে নকল করার মননশীলতা। তুমি সেটা বঙ্কিমের মধ্যে পাবে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পাবে। বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে পাবে আর বলাই বাহুল্য।

রাজু : সুধীন্দ্রনাথ দত্তে।

হুমায়ুন আজাদ : সুধীন্দ্রনাথ দত্তেও পাবে। আমি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসুর বহু রচনা পড়ে-যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম- তখন মুগ্ধ হয়েছি, উচ্ছ্বসিত হয়েছি। যখন আমার পড়ার পরিধি বাড়লো আমি দেখলাম এই সমস্ত জিনিস এলিয়টে আছে, পাউণ্ডে আছে, ইয়েটস-এ আছে। এমনকি মজার বিষয় হলো আবু সয়ীদ আইয়ুবের সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার ভূমিকাটি এখানে খুব প্রশংসিত। কিন্তু ওটিরও উৎস এডমান্ড উইলসন-এর এক্সাস ক্যাসল-এর ভূমিকা। এটি অত্যন্ত চমৎকার বই। এই বইটিতে রয়েছে আধুনিক কবিতা, প্রধানত প্রতীকবাদী কবিতার অতুলনীয় ব্যাখ্যা। এবং ওর প্রথ। পরিচ্ছেদে যে আলোচনা রয়েছে তার অনেকটা ভুল এবং নিন্মমানের সারাংশ তুমি পাবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের মধ্যে। বঙ্কিম পড়, সেখানেও দেখবে, বঙ্কিমের চিন্তাগুলো, তাঁর প্রবন্ধগুলো ঐ সময়ের বিখ্যাত প্রবন্ধ বা গ্রন্থের নানারকম প্রতিধ্বনি বা বঙ্গীয়করণ রূপ।

রাজু : তার পরও, দেখা যায়, আপনার ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থে তিরিশের সুধীন্দ্রনাথের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন এবং তার চেতনাগত নেতির জগৎকে আপনি অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। তাঁকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে করেন।

হুমায়ুন আজাদ : আমি মননশীলতার কথা বলছিলাম। মননশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক কিছু নেই। কিন্তু কবিতা লেখা হচ্ছে ভিন্ন ব্যাপার। কবিতার ভেতরে যে আবেগ রয়েছে তারও কিন্তু একটা মননশীল ভিত্তি থাকতে পারে। যেমন, রোমান্টিসিজমের একটি মননশীল ভিত্তি রয়েছে। প্রতীকবাদেও একটি মননশীল ভিত্তি রয়েছে। সমস্ত কবিতা, শিল্পকলা সৃষ্টির পেছনে একটি মননশীলতা রয়েছে বা মননশীলত্ত্ব রয়েছে। এই তত্ত্বগুলো আমরা পশ্চিম থেকে নিয়েছি। আধুনিক চেতনার ব্যাপারটিও আমরা পাশ্চিম থেকে নিয়েছি। কিন্তু কবিতায় যখন আসবে, যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অসাধারণ কবিতা লিখেছেন, বাংলার পটভূমিতে তো বটেই, সারা বিশ্বের পটভূমিতেও। জীবনানন্দ দাশ অসাধারণ কবিতা লিখেছেন এবং সমগ্র বিশ্বের পটভূমিতেই।

রাজু : সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে কি জীবনানন্দের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

হুমায়ুন আজাদ : আমাদের এখানে একটা প্রবণতা রয়েছে যে, আমরা একজনকেই বেছে নিতে চাই, একজনকে বেছে অন্যদের বাদ দিলে যেন আমরা খুব সুখ পাই। একটি জগৎ একজনে সৃষ্টি হয় না। জীবনানন্দের মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার মধ্যে অসাধারণত্ব রয়েছে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তে বিশেষ বিশেষ ধরণের অসাধারণত্ব রয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর অন্য ধরনের অসাধারণত্ব রয়েছে, বিষ্ণু দের অন্য ধরনের অসাধারণত্ব রয়েছে। আমাদের প্রবণতা একজনকে বেছে অন্যদেরকে ফেলে দাও-এটা ঠিক নয়। এবং জীবনানন্দ নিয়ে যে মাতামাতি সেটির একটি সীমা থাকা উচিত । জীবনানন্দের কবিতা প্রায় সম্পূর্ণ অকবিতায় পরিণত হয়ে গেছে যখন তিনি স্বপ্ন, ঘোর, কাতরতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা থেকে উঠে বর্তমান বিশ্বে প্রবেশ করছেন এবং যখন তিনি রাজনীতি নিয়ে ভাবছেন, বিশ্বের কল্যাণ নিয়ে। তখন আর এগুলো কবিতা হয়ে ওঠেনি।

রাজু : তার শেষ দিককার কবিতার কথা বলছেন?

হুমায়ুন আজাদ : হ্যাঁ, শেষ দিককার, সম্ভবত বেলা অবেলা কালবেলার পরে যা কিছু লিখেছেন সেগুলোর অধিকাংশই কবিতা হয়নি। জীবনানন্দ হচ্ছেন আবেগ, ঘোর, স্বপ্নকাতরতার কবি। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মননশীলতার পাশে তিনি শিশু। জীবনানন্দের প্রবন্ধ এত সাধারণ... এমনকি জীবনানন্দের প্রবন্ধ, মজার ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ বক্তব্যই পশ্চিম থেকে নেয়া। এমনকি জীবনানন্দের সেই কবিতার কথা’র যে বিখ্যাত উক্তি ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ এবং প্রাসঙ্গিক অনেক বক্তব্য ইংরেজি ভাষার প্রবন্ধ থেকে নেয়া। তাঁর সময়ে যে ইংরেজি রচনাগুলো জনপ্রিয় ছিলো এবং পাঠ্য ছিলো, এগুলো এখন আমাদের পরিসীমার বাইরে। ফলে আমরা সহজে উদ্ধার করতে পারি না ঠিক কোথা থেকে নিয়েছে। সুধীন দত্ত কোন মৌলিক চিন্তা করেননি। কিন্তু তিনি পশ্চিম থেকে যে চিন্তা গ্রহণ করেছেন সেটিকে অসাধারণভাবে বাংলায় প্রকাশ করেছেন।

রাজু : ফরহাদ ভাই তো সুধীন দত্তকে অশিক্ষিত বলে মনে করেন।

হুমায়ুন আজাদ : ফরহাদ এখনও অ আ ক খ-ই শিখেনি। আমাদের তো বিকারগ্রস্ত, কত উন্মাদ প্রতিভা হয়ে আছে এবং এখন হয়েছে কী, মূর্খতার একটি ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে। আমাদের এখানে এখন ভাবা হচ্ছে পাগল, ছাগল, আউল-বাউলরাই প্রতিভা। এই লালন ফকির নিতান্তই এক উন্মাদ, কিন্তু তাঁর বুকে কিছু যন্ত্রণা ছিলো, কিছু ব্যথা ছিলো, কিছু কাতরতা ছিলো যা গান হয়ে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর বক্তব্য সম্পূর্ণ পচা। ওঁর ওই যে অচিন পাখি বা কুঠুরী এবং তার দরজা, এগুলো হচ্ছে শিশুর না বুঝার বিলাপ।

রাজুঃ ফরহাদ ভাই তো এগুলোর একটা মননশীল ব্যাখ্যা দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

হুমায়ুন আজাদ : ফরহাদকে নিয়ে আলোচনার কোন দরকার নেই। সে খুবই চিন্তার বিকারে ভুগছে। সে এনজিও করে। মার্কিন ক্যাথলিক চার্চের টাকায় সে চলে এবং সে মার্কিন দেশের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখে। তার প্রবণতা হচ্ছে সাদ্দাম হোসেনের মতো।

রাজু : মার্কিন টাকা নিয়ে কি মার্কিনিদের বিরোধিতা করা সম্ভব?

হুমায়ুন আজাদ : এই জন্যই তো ফরহাদের সমস্ত রচনার মধ্য একটি বেদনাদায়ক করুণ বিকারের ছাপ রয়েছে। বহু স্ববিরোধিতার মধ্যে তাকে বাস করতে হচ্ছে। এখন ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে।

রাজু : আপনি যাদেরকে পচা বললেন, রবীন্দ্রনাথ নিজে তো তাদের ব্যাপারে সপ্রশংস ছিলেন।

হুমায়ুন আজাদ : রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, কারণ তার সেই মননশীলতা ছিলো না বুঝার মতো। বিলাপ দর্শন নয়, উচ্ছাস দর্শন নয়। দর্শন হচ্ছে বিশ্বের কোন প্রপঞ্চ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে তার সূত্র উদঘাটন করা। শিশুরা বিস্মিত হয় বোঝে না বলে, দার্শনিকরা বিস্মিত হয়, কিন্তু দার্শনিক আর শিশুর পার্থক্য হচ্ছে শিশু ঐ বিস্ময়ের মধ্যে থেকে যায় আর দার্শনিক বিস্ময়কে অতিক্রম করে সত্য উদঘাটন করে। আমাদের বাউল যারা তাদের কয়জনের কিছু গান তাদের আবেগ, স্বপ্ন, কাব্যকথা এবং অবাস্তবের জন্য চমৎকার। কিন্তু এইগুলো চিন্তার প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করার কোন কারণ নেই।

রাজু : আপনি তো একটু আগে স্ববিরোধিতার কথা বললেন কিন্তু আপনি নিজেও তো এই স্ববিরোধিতার মধ্যে আছেন। আমাদের কয়েকজন সম্পর্কে একসময় যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন পরবর্তীতে তা বদলে গেছে। একসময় আপনি সৈয়দ হক সম্পর্কে নিন্দা করতেন।

হুমায়ুন আজাদ : সৈয়দ হককে নিন্দা করা... তার লেখাকে আমি কখনোই নিন্দা করিনি।

রাজু : খেলারাম খেলে যা সম্পর্কে আপনি নিন্দা করেছেন।

হুমায়ুন আজাদ : খেলারাম খেলে যাকে আমি এখনও গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বলি না। সৈয়দ শামসুল হকের সার্বিক কর্ম, রচনাবলির মূল্য আমি সব সময়ই স্বীকার করি। ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ শামসুল হক আমাকে আক্রমণ করেছিলেন, আমি তাকে প্রতিআক্রমণ করেছি এবং তার ‘খেলারাম খেলে যা’কে আমি হয়তো একটু নিন্দাই করেছিলাম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সৈয়দ শামসুল হককে আমি সম্পূর্ণরূপে নিন্দা করেছি। বরং বাংলাদেশে আমিই সব সময় কথায় এবং লেখায় গুরুত্ব দিয়েছি। আধুনিক বাংলা কাব্য সংগ্রহে তার প্রচুর কবিতা নেয়া হয়েছে, সাধারণত তাকে এতোটা মূল্য দেয়া হয় না। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক। সার্বিক কর্মকাণ্ডে তিনি শামসুর রাহমানের চেয়ে অনেক বড়-এই ব্যাপারটি আমাদের এখানে কেউ বোঝে না।

রাজু : আপনার ঐ সংকলনে আল মাহমুদের কবিতা নিলেন না কেন?

হুমায়ুন আজাদ : সেটা ভূমিকায় ব্যাখ্যা করা আছে।

রাজু : ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু সেটা তো গ্রহণযোগ্য হয়নি।

হুমায়ুন আজাদ : গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তার কারণ বইটি মুদ্রণের পরপর মুদ্রণ হচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে আল মাহমুদ ছাড়াও বাংলা কবিতা চলে।

রাজু : এটা তো আপনার কবিতা ফেলে দিলেও চলবে।

হুমায়ুন আজাদ : সে-ই। কিন্তু গ্রহণযোগ্য হয়নি যদি বলো তাহলে এই বই পাঠকরা কিনতো না । বইয়ের মুদ্রণের পর মুদ্রণ হচ্ছে। আমি তো আল মাহমুদকে বাংলা কবিতা থেকে বহিস্কার করে দেইনি। আমি বলেছি যে আমার এই সংগ্রহে তাকে এই কারণে অর্থাৎ তার প্রতিক্রিয়াশীলতা, একনায়কদের পদধূলি গ্রহণ করার যে স্বভাব এজন্য আমি নিচ্ছি না ।

রাজু : আপনি একনায়কের পদধূলি গ্রহণের অভিযোগে তার নিন্দা করছেন। কিন্তু আপনি নিজেও তো একনায়কের মতোই আচরণ করলেন সংকলন থেকে বাদ দিয়ে।

হুমায়ুন আজাদ : এটা একনায়কের মত নয়। প্রতিটি সংকলন হচ্ছে সম্পাদকের রুচি অনুসারে বিন্যস্ত সংগ্রহ। আমি সৎ বলে ভূমিকায় এই কথাটি উল্লেখ করে দিয়েছি যে এদেরকে আমি এই জন্য নিলাম না। আমি তো বলিনি ওরা কবি নয় । বরং ওরা, ওদের সংগ্রহগুলো লক্ষ করলে দেখতে পাবে ওরা কী কাণ্ড করে।

রাজু : আপনার সততা নিয়ে আমাদের কোন সংশয় নেই। আমি বলছিলাম কাজটি স্বৈরাচারী...

হুমায়ুন আজাদ : এটি স্বৈরাচারী নয়, এটি হচ্ছে আমার রুচি অনুসারে বিন্যস্ত সংগ্রহ। আমি কিছুতেই একজন কবি, যে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে, একনায়কের পদধূলি নিচ্ছে, যে আধুনিকতার বিরুদ্ধে চলে গেছে তাকে আমার এই আধুনিক কাব্যসংগ্রহে নিতে পারি না। নিলে একটি গোলমালও হতো। আল মাহমুদ একটু বিরক্তিকর মানুষ তো-বিরক্তির সৃষ্টি করতো এই বলে যে আমার অনুমতি ছাড়া কেন কবিতা নিলো এবং আরেকটি হয়তো বলতো, দেখ, হুমায়ুন আজাদ আমাদেরকে তার সংগ্রহে নিয়েছে, কাজেই আমরা কোথায় প্রতিক্রিয়াশীল, আমরা খুবই আধুনিক এবং প্রগতিশীল।

রাজু : আপনি তাকে প্রগতিশীল হওয়ার সুযোগ দিতে চান না?

হুমায়ুন আজাদ : হাঃ হাঃ হাঃ। তাকে প্রগতিশীলতার প্রশংসাপত্র কপালে আমি দিতে চাই না।

রাজু : কিন্তু আপনি তাকে প্রগতিশীল হওয়ার সুযোগটা দিতে চান না কেন?

হুমায়ুন আজাদ : প্রগতিশীল হতে হবে তাকে। সে জায়নামাজে বসে পরস্ত্রী ধর্ষণের-কবিতা লিখবে এবং প্রগতিশীল হবে-এটা হতে পারে না।

রাজু : আপনি নিজে ষাট দশকের লেখক। তো আপনার নিজের দশকের এবং তার আগের দশকের লেখকদের মধ্যে কাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ লেখক বলে মনে করেন?

হুমায়ুন আজাদ : আমার আগের দশকে শামসুর রাহমানের কথাই বলি। শামসুর রাহমান আসলেই সর্বপ্রধান কবি কিনা? আমি নিজেই একটা বই লিখেছিলাম তাকে নিয়ে যখন আমার বয়স ছিলো ঊনত্রিশ বছর। অনেকেই আমাকে বলে থাকে, এমনকি পরিহাসও করে যে শামসুর রাহমান এই যে প্রধান কবি এবং গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে উঠলেন এর পেছনে আমার এই বইটি একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখন আমাদের সকলের বয়স বেড়েছে। এখন আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে? আমার কথাই যদি বলি। আমি শুধু কবিতাই লিখিনি। আমি নাটক ছাড়া সাহিত্যের সবগুলো শাখায় লিখেছি এবং এমন কিছু এলাকা আছে যেগুলো সৃষ্টিশীল লেখকরা জানে না। যেমন ভাষাবিজ্ঞান, বাক্যতত্ত্ব এবং ইংরেজিতেও আমার বই রয়েছে। সব মিলে আমি যে কাজ করেছি তার তো একটি সার্বিক মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এখন কবিতার কথাই যদি বলি, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসল হক, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ- এদের মধ্যে কে কতো বড় কে কতো ছোট এটা বিচার করা যেতে পারে। আমাদের এখানে প্রচারে অনেকে অনেক বড় হয় এবং প্রচারের অভাবে অনেকে প্রতিভার মূল্য পায় না। আমি এখন শামসুর রাহমান এবং অন্য যাদের নাম বললাম তাদের সকলের কবিতা যখন বিচার করি তখন বুঝতে পারি এদের মধ্যে শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ বা আল মাহমুদ বা আমার কথাই বলতে পারি; এরা আমার থেকে খুব বড় কবি নন। গত বিশ-বাইশ বছরে শামসুর রাহমান প্রাচুর্যে বেড়েছে। ঐ প্রাচুর্য আমি কবিতার ক্ষেত্রে দিতে পারিনি কিন্তু আমি যে পরিমাণ গদ্য লিখেছি তা জড়ো করলে অনেকের সমগ্র লেখার তিন-চার গুণ হয়ে যাবে। এই যে কবিদের কথা বললাম এরা কেউ খুব বেশি বড় নয় এবং কেউ অন্যদের চেয়ে বেশি ছোট নয়। যেমন শামসুর রাহমানের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থের পর যে কাব্য সেগুলো তাকে কেবল প্রাচুর্য দিয়েছে। এগুলো তাকে আরো বড় কবিতে পরিণত করেনি। কিন্তু কবিতা বেশি লিখেছেন বলে এবং নানা কারণে প্রচুর প্রচার পেয়েছেন বলে তাকে এখন খুব বড় বলে গণ্য করা হয়। নইলে এই যে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো তারা মোটামুটি একই মাপের কবি।

রাজু : আপনি একটু আগে বললেন, কখনো কখনো প্রচারের কারণে অর্জনের তুলনায় বেশি পেয়ে যায় আবার প্রচারের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকও আড়ালে থেকে যান। এ রকম কে আছেন?

হুমায়ুন আজাদ : যেমন, মনে করা যাক, যদি ঠিকমতো প্রচার পেতো, তাহলে সৈয়দ শামসুল হকের উচ্চতা আরও বেশি হতো। আমার উচ্চতা যদি তুমি কিছু মনে না করো- যদি তুমি আমার কবিতা, ভাষা-বিজ্ঞান, সমালোচনা, উপন্যাস, কিশোর সাহিত্য, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, সব মিলিয়ে বিবেচনা কর– কিছু মনে করো না- তাহলে আমার উচ্চতা করটা হয় তা পরিমাপ করার চেষ্টা করে দেখতে পার। শুধু কবিতা লেখার একটা সুবিধা আছে এই দেশে। একমাত্রিক লেখকদের আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। আমাদের ক্ষেত্রে মুশকিল হচ্ছে আমাকে কী বলবে? অধ্যাপক ডক্টর, কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, কলা লেখক, কী বলবে? এবং বিব্রত হয়ে কিছুই বলে না। এমন একটি অবস্থা। ‘স্যার’ বলে শেষ করে। আমি প্রিয় ‘ভাই’ হয়ে উঠিনি।

রাজু : আপনি বোধ হয় ভাই বলার সুযোগও দেন না।

হুমায়ুন আজাদ : না, না-দেয়াই ভাল। আমি ভাই না হয়েই ভালো আছি। যারা ভাই বলে ডাকে ওরা আমার ছাত্র হওয়ারও যোগ্য নয়।

রাজু : স্যার, আপনার স্ত্রী কি আপনাকে স্যার বলে ডাকেন? কিংবা আপনার ছেলে- মেয়েরা আপনাকে বাবা বলেন নাকি স্যার বলে ডাকেন?

হুমায়ুন আজাদ : সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। শোনো, কাজেই এই যে বড় আর ছোট বলা হয়, ওরা অত বড় আর ছোট নয়। এরা একই মাপের! শুধুমাত্র প্রচারের কারণে

রাজু : মুদ্রাস্ফীতির মতো বাড়ছে?

আজাদ : হাঃ হাঃ। হ্যা, এভাবে ওরা বড় হয়ে উঠেছে।

রাজু : প্রায়ই দেখা যায় এই দেশে ইসলামি বিষয় নিয়ে কেউ কিছু লিখলে আপনি তাদেরকে রক্ষণশীল বা মৌলবাদী বলেন। কিন্তু পশ্চিমের এমন অনেক লেখকই আছেন যারা ধর্মীয় বিষয় অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন। যেমন টি এস এলিয়ট, এমনকি ইয়েটস-এও আছে। তাদেরকে কিন্তু আপনি প্রতিক্রিয়াশীল বলছেন না।

হুমায়ুন আজাদ : অবশ্যই বলেছি। আমার অবিশ্বাস বইটিতে এলিয়েটের কবিতা কতোটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং তার কবিতার বিষয়বস্তু কতোটা বাজে এবং গ্রহণযোগ্য নয়-কবিতা হিসেবে অসাধারণ হয়েও-সারবস্ত গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি সাধারণ মানুষ থেকে অনাধুনিক-আমার অবিশ্বাস-এ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

রাজু : ওটা তো আপনি সুনির্দিষ্ট একটা চেতনাবিন্দু থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। ঐ অর্থে তো, আপনি বলেছেন, বিশ্বসাহিত্যের অধিকাংশই বাজে।

হুমায়ুন আজাদ :সেটাই। পশ্চিমের যারা মৌলবাদী তাদেরকে আমি মৌলবাদী বলি এবং এলিয়টের সমস্ত বিশ্বাস ছিলো ভ্রান্ত। তার আধুনিক চেতনা যেখানে... বিশেষ করে তার চিত্রকল্প, এগুলো খুব অসাধারণ। কিন্তু আমি মনে করি না বিংশ শতাব্দী একটি ওয়েস্টল্যান্ড। তিনি বলছেন বিংশ শতাব্দী একটি পোড়োজমি কারণ এখানে বিশ্বাস নেই। বিশ্বাশীনতার জন্যই এটি পোড়োজমি হয়ে গেছে। আমি তা মনে করি না। বরং আমি মনে করি বিংশ শতাব্দী মানুষের ইতিহাসে উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ শতাব্দী। আমি যদি বিংশ শতাব্দীর না-হতাম তাহলে আমার  কোনো স্বাধীনতা থাকতো না। তুমি যে আমার কথা রেকর্ড করছো এটা বিংশ শতাব্দীর কারণে। প্রচুর বাজে কথায় এলিয়ট ভরপুর ছিলো। তার অধিকাংশ কবিতা হচ্ছে ধর্মীয়। তার প্রায় সব নাটক হচ্ছে ধর্মের কাহিনীভিত্তিক; এমনকি চার্চের পয়সা নিয়ে  তিনি নাটক লিখেছেন। তার কবিতার অসাধারণত্ব আমি স্বীকার করি, কিন্তু তার বিশ্বাস লালন ফকিরের বিশ্বাসের মতোই বাজে।

রাজু : নজরুল ইসলামের ব্যাপারে আপনি এতো নিন্দুকের ভূমিকায় কেন? আপনি তো নজরুলকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। কবিতার এক জায়গায় আপনি বলেছেন, 'তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল'।

আজাদ : হাঃ হাঃ। শোনো, নজরুল সম্পর্কে আমার আর অধিকাংশ মৌলবাদী বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন। নজরুলকে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই ভালোবাসি। আমি খুবই ভালোবাসি। তার বহু কবিতার বহু পঙক্তি আমার মুখস্থ । তার বহু গানের স্তবকের পর স্তবক আমার মুখস্থ। তাকে আমি ভেতরে ভেতরে ভালোবাসি। তার মানে তার সমস্ত অপরাধকে আমি ক্ষমার চোখে দেখবো-এমন নয়। আমি ভক্ত নই, আমি বিশ্লেষণকারী। তার সবচে ভালো কবিতা হচ্ছে দারিদ্র্য। দারিদ্র’-এর আমি অসাধারণ অনুরাগী বলা যেতে পারে।

রাজু : এটা আমার মোটেই পছন্দের কবিতা নয় । উনি বলেছেন, ‘হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছে মহান'... দারিদ্র্য কী করে একজনকে মহান করে?

হুমায়ুন আজাদ : না, না। এই কবিতাটি... তুমি তো বোধ হয়, এই কবিতাটি পুরোপুরি পড়ে ওঠার সময়ও পাওনি।

রাজু : কী করে বুঝলেন, সময় পাইনি?

হুমায়ুন আজাদ : তাহলে তুমি বুঝতে। এই কবিতায় একটি বৈপরীত্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান, ... দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান, কণ্টক মুকট শোভা’। তুমি তো ‘কণ্টক মুকুট শোভা’র চিত্রকল্প বুঝতেও পারছ না বলে আমার ধারণা। বলো কী?

রাজু : এটা তো জেসাস ক্রাইস্ট।

হুমায়ুন আজাদ : তাহলে বেশ ভালো। তুমি এটা বুঝতে পারছো। অধিকাংশ লোক এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু পরে ক্রমশ দারিদ্র্যের জয়গান গাওয়ার পর যখন বাস্তবে নেমে এলো, তখন দেখতে পারছে যে ‘জায়া হয়ে পুত্র হয়ে কাঁদে অহরহ আমার দুয়ার ধরি, কোথায় পাবো অনিন্দিত সুন্দরের হাসি হেরি মোর কল্পলোক’ ইত্যাদি। এখন, নজরুল নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি, নজরুল যে চমৎকার চমৎকার পোজ দিতে পছন্দ করতো, সেই ছবিগুলোর একটি ভাষা দিয়েছি কবিতাটিতে, কিন্তু ওগুলো আমার কাছে আকর্ষণীয় নয়। শেষ বয়সে যে নজরুল কাঁদছেন, বিড়বিড় করছেন-এটি আমার কাছে মনে হয়েছে এই সভ্যতা একজন নজরুল ইসলামকে উন্মাদ করে দিতে পারে। তিনি এই সভ্যতাকে যতোই বদলানোর চেষ্টা করুন না কেন। কিন্তু নজরুলের সীমাবদ্ধতাও আমি বুঝি। তার কাব্যজীবনকে লালিত-পালিত করেছে প্রধানত ইসলাম। তিনি যে একই সাথে ইসলামি সঙ্গীতও লিখবেন-এটা আমি আধুনিক একজন মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না। নজরুলের মধ্যে এক ধরনের আধুনিকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার মিশ্রণ ছিলো। তার কোন মননশীলতা ছিলো না ।

রাজু : আপনি তার যে ইসলামি গানের কথা বললেন, গুণ দা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, নজরুল ইসলাম যদি ঐ সব ইসলামি গান, হামদ, নাত না লিখতো তাহলে ওগুলো নাকি আপনার লিখতে হতো।

হুমায়ুন আজাদ : গুণের কোন মননশীলতা নেই, সে এসব বোঝে না, ইয়ার্কি করে, এটা তুমি ছেড়ে দিতে পার। গুণ বিশ্ব, বিশ্বের বদল, সভ্যতার রূপ, শিল্পের বিবর্তন-এসব কিছু বোঝে না। ইয়ার্কি করে ওর জীবন কাটছে।

রাজু : কিন্তু তিনি তো ভাল কবিতা লিখেন এবং তাঁর গদ্যও খুব ভালো।

হুমায়ুন আজাদ : না, তার কবিতাও ভালো নয়, তার গদ্যও ভালো নয়।

রাজু : আপনি কি তার আমার কণ্ঠস্বর পড়েছেন?

হুমায়ুন আজাদ : কী? অনেক অংশ পড়েছি। ওটা যে... ওটা সম্পর্কে আমি মন্তব্য করতে চাই না।

রাজু : তবে ওটা, একটা চমৎকার বই।

হুমায়ুন আজাদ : না, ওটা চমৎকার বই না। ওটি হচ্ছে, একজন আত্মপ্রেমিকের আত্মগবেষণার করুণ উদাহরণ।

রাজু : ওটার মধ্যে একই সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসও আছে।

হুমায়ুন আজাদ : তুমি মুগ্ধ হয়ে থাকো, আমার কোনই আপত্তি নেই ।

রাজু : ঠিক আছে, স্যার। আপনার বই থেকেই একটা প্রশ্ন করি। তার আগে উদ্ধৃতি দেই : ‘বর্তমান বিবাহরীতিতে নারীপুরুষ উভয়ই অসুখী। এখন পৃথিবী জুড়ে চলছে অবিশ্বাস ও অপ্রেমের সংসার।’ আপনিও কি তাহলে অসুখী এবং অপ্রেমের সংসার করে যাচ্ছেন? আপনি প্রথাবিরোধী লেখক হয়ে প্রথানুগ বিবাহিত জীবনে গেলেন কেন? 

হুমায়ুন আজাদ : হাঃ হাঃ হাঃ। এ ধরনের প্রশ্ন সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের করলে খুব মজার হবে । আমি তাত্ত্বিক আলোচনা লিখেছি, যেখানে বিবাহ, বিবাহরীতির সাফল্য এবং ব্যর্থতা, বিশেষ করে ব্যর্থতাই আলোচনা করেছি। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনার কোন দরকার নেই। সেটা পরে লেখার যদি প্রয়োজনবোধ করি, তাহলে লিখেই জানাবো। তোমার এই হলদে সাংবাদিকতার দরকার নেই।

রাজু : এটা হলদে সাংবাদিকতা নয়। আপনি হলদে বলে সত্য এড়িয়ে যাচ্ছেন।

হুমায়ুন আজাদ : এটা হলদে সাংবাদিকতাই ।

রাজু : আপনার প্রত্যেকটা বইয়ের সাথে নায়কমার্কা দু'তিনটা ছবি দেখে মনে হয় আপনার মধ্যে অভিনেতা হওয়ার গোপন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হয়েছে।

হুমায়ুন আজাদ : না, আমার কখনোই অভিনেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিলো না, ওটা রবীন্দ্রনাথের ছিলো, নজরুলের ছিলো। আমার বইয়ে আমার ছবি তো থাকবেই কিছু নইলে তমি ছাপবে কী এবং পরবর্তীকালে লোকজনে কী ছাপবে। এখন তুমি আমাকে মূল্য না দাও কিন্তু আগামী কয়েকশ' বছর এসব ছবি-টবি নিয়ে থাকতে হবে।

রাজু : আপনি বলেছেন বিবাহরীতিতে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু আপনি জীবনে অন্যটা প্র্যাকটিস করছেন কেন? এটা কি আপনার অসততা বলবো না?

আজাদ : ব্যাপারটি বুঝতে পারছ না। বিবাহবিষয়ক যে ধারণায় আমি এখন পৌছেছি . সেটি আমি বিবাহ যখন করেছি তখন এই ধারণা ছিলো না। আমি বিয়ে করেছি ২৮ বছর বয়সে। তখন আমার এই সমস্ত ব্যাপারগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা-পড়াশুনা ছিলো না। তা-ও আমি যদি ইউরোপে বা আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করতাম তাহলে সম্ভবত এই বিবাহ হতো না।

রাজু : তসলিমা নাসরিন তো আপনার মতোই বিতর্কিত লেখক। তাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

হুমায়ুন আজাদ : তসলিমা ব্যক্তিগত জীবনে অসৎ, কিন্তু কয়েকটি কয়েকটি ভালো কবিতা লিখেছে, কয়েকটি ভালো কলাম লিখেছে ।

রাজু : অসৎ কোন অর্থে?

হুমায়ুন আজাদ : ব্যক্তিগত জীবনে অসৎ। এর আর ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই।

রাজু : একাধিক বিয়ে করেছেন বলে?

হুমায়ুন আজাদ : তোমার অসততার মানদণ্ড হচ্ছে বিবাহ এবং বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক। আমি সেটাকে অসততা বলছি না। অসততা হচ্ছে যে সৎ নয় সে অসৎ ।

রাজু : অসততা কোথায় সেটা তো সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না এটা আপনার সুইপিং কমেন্ট, উদাহরণ না দিলে আমরা কী করে বিশ্বাস করবো?

হুমায়ুন আজাদ : উদাহরণ হচ্ছে, স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সে নানা কিছু করতে পারে। এটা হচ্ছে তার সততার অভাব বা অসৎ। আমাকে সে অন্তত তিন বছর টেলিফোন করেছে, তিন বছর আমার পরামর্শ নিয়েছে টেলিফোনে। কিন্তু পরে দেখলাম আমার বিরুদ্ধে কমপক্ষে সাত/আটটি কলাম লিখেছে। আমি বিস্মিত হয়েছি যে কোন কারণ নেই। ফলে এটা একটা অসততা। আর উদাহরণ দিতে চাচ্ছি না।

রাজু : আমার অবিশ্বাস-এ আপনি বলেছেন যেসব গন্ধ খুব ভদ্র নয়, সাধারণ আমরা পেতে চাই না—এগুলোতেও আমি সুখ পাই। কিন্তু মানুষ ভিন্ন পথে এমন এক গন্ধ ত্যাগ করে সেটা কেউ পেতে চায় বলে মনে হয় না। আপনি এটাকেও সুখ বলবেন?

হুমায়ুন আজাদ : তোমরা একটু বিকারগ্রস্ত মানুষ...

রাজু : বিকারগ্রস্ত আমরা নাকি আপনি?

হুমায়ুন আজাদ : আমি ঐ কথা বলিনি। তুমি আবার বোধ হয় অন্য গন্ধকে পছন্দ কর। আমি বলেছি পচা পাটের গন্ধ, যেহেতু এটি আমার বাল্যকালের সাথে যুক্ত। আর অন্যান্য গন্ধযা-আছে মুগদাপাড়ার যে আবর্জনার স্তুপ, তুমি ওখানে গিয়ে বসে থাক, তোমার হয়তো ভালো লাগবে। বা ঐ অন্য পথের গন্ধের কথা বলেছো, তোমার হয়তো ভালো লাগবে ।

রাজু : কয়েক বছর আগে এক তরুণীকে আপনার সারা সন্ধ্যা চুষতে চিবুতে ইচ্ছে করেছিলো। সেই তরুণীটি কে?

হুমায়ুন আজাদ : এভাবে বলা বোধ হয় ঠিক নয়। এটা আমার কবিতার পঙক্তি ।

রাজু : হ্যাঁ, কবিতার পঙক্তিই, আপনি এটা আবার ‘আমার অবিশ্বাস’-এ কোট করেছেন।

হুমায়ুন আজাদ : এটি আমার কবিতার পঙক্তি . ... এটি আমার উপন্যাসেও আছে নাকি?

রাজু : আমার মনে পড়ে না।

হুমায়ুন আজাদ : এটা আমার কবিতার পঙক্তি। কাজেই এটাকে তুমি যেভাবে উল্লেখ করছো তাতে মনে হচ্ছে এটি আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা-তা নয়। আমার কবিতায় যেমন প্রেমের ব্যাপার রয়েছে, তীব্র শারীরিক কামনা রয়েছে এবং এটা যে কতো তীব্র হতে পারে এবং রূপময় হতে পারে সেই ব্যাপারে একটি কবিতা এটি। এটা যে আমার ব্যক্তিগত এমন নয়। তবে হ্যা, আমার ইন্দ্রিয়রাশি তীব্র এবং প্রবল। আমি দেখে মুগ্ধ হই এবং শুনে আলোড়িত হই। আবার আমি যখন মননশীল হই তখন আমি ঝামা পাথরের মতো হতে পারি।

রাজু : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ যেটি চেতনার দিক থেকে পুরোপুরি নেতিবাচক, কিন্তু ঐ বইটিতেই ‘ব্লাডব্যাংক’ বলে একটি কবিতা আছে সেটি অন্য রকম, অন্তত ঐ বইয়ের মূল চরিত্রের বিরোধী।

হুমায়ুন আজাদ : ‘ব্লাডব্যাংক’ সম্ভবত এমএ শ্রেণীতে থাকার সময় লেখা । হয়তো উনসত্তরে লেখা, আমার সঠিক মনে নেই। তখন তো আন্দোলনের পর আন্দোলন চলছিলো। আমি তো তথাকথিত জনগণের কবিতা বেশ কিছু লিখেছি। তখন বোধ হয় আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়াই। ছাত্ররা ধরেছে, স্যার আন্দোলন চলছে একটি কবিতা দিতে হবে। তখন বাংলাদেশকে ব্ল্যাডব্যাংক মনে হয়েছে। চিত্রকল্পটি আমার মাথায় প্রথম আসে। এই কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পোস্টার করা হয়েছে। তবে ব্লাডব্যাংকে আমি ভালো কবিতা মনে করি না।

রাজু : আপনি কোনগুলোকে ভালো কবিতা বলে মনে করেন? সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে?

হুমায়ুন আজাদ : এটি একটি ভালো কবিতা, ‘ব্লাডব্যাংক'-এর চেয়ে অনেক অনেক অনেক ভালো এবং জটিল।

রাজু : আপনার নেতিবাচক অবস্থানের কারণেই বোধ হয় আপনি অন্ধকারাচ্ছন্ন কবিতাগুলো বেশি পছন্দ করেন।

হুমায়ুন আজাদ : নেতিবাচক নয়... তুমি দেখবে, ব্লাডব্যাংক’ সরল একটি কবিতা। তোমার ভালো লাগতে পারে।

রাজু : আমার তো সরল এবং জটিল দুটোই ভালো লাগে।

হুমায়ুন আজাদ : না, এটাকে আমি খুব খারাপ বলছি না, এটা সরল সাধারণ আবেগ-জাগানো কবিতা।

রাজু : আপনার ভালো-লাগা কবিতা কোনগুলো?

হুমায়ুন আজাদ : আমার কবিতার তালিকা আমার দেয়া তো ঠিক হবে না ।

রাজু  : আমি দেখতে চাচ্ছিলাম নেতিবাচক কবিতাগুলোই আপনি পছন্দ করেন কিনা।

হুমায়ুন আজাদ : না, নেতিবাচক নয়, যে কবিতাগুলোতে জটিল বোধ আবেগ প্রকাশ পেয়েছে, অভাবিত চিত্রকল্প এবং আমার উপলব্ধির যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। আর ‘ব্ল্যাডব্যাংক’ আমার তো মনে হয় এটি খুব আধুনিকও নয়। তবু যেহেতু লিখেছিলাম., আমার ভালো লাগা কবিতা হচ্ছে, ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘আমার কুঁড়েঘরে’। এমনকি গত কয়েক বছর আমি যে কবিতা লিখেছি, দুটো কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে কাফনে মোড়া অশ্রিবিন্দু নামে। এই কবিতা কিন্তু অনেক সরল, কিন্তু আধুনিক। আমি কিন্তু রবীন্দ্রপূর্ব সারল্যে ফিরে যাবো না। যেতে পারি না। আমার সারল্য আধুনিকের সারল্য। আমার শেষ বইয়ের প্রতিটি কবিতাই প্রিয় ।

রাজু : আপনি একটি লেখায় লিখেছেন যে “জীবন, আমাদের সুন্দর জীবন তার কোন অর্থ নেই। অর্থের দরকার নেই।‘ আবার এই লেখাটির শেষ বাক্যে বলেছেন, “অর্থপূর্ণ শুধু দুই অন্ধকারের মাঝখানের হঠাৎ ঝালকানিটুকু। এটা কি স্ববিরোধী বক্তব্য হচ্ছে না?

হুমায়ুন আজাদ : স্ববিরোধী ব্যাপারও বুঝতে পারছ না। এটি শেষ যখন হলো তখন এলো একটি কাব্যিক চিত্রকল্প । জীবনকে বলা হচ্ছে দুই অন্ধকারের মধ্যবর্তী আলোর ঝিলিক। এই যে বেঁচে আছি, এই বেঁচে থাকাটাই অর্থ, এর বাইরে আর কোন অর্থ নেই।

রাজু : জীবনটা অর্থহীন কিন্তু বেঁচে থাকাটা অর্থপূর্ণ?

হুমায়ুন আজাদ : বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে জীবনের অর্থ, আর কোন অর্থ নেই। এত নিরর্থক এ জীবন। এটাকে সার্থক করার একটি উপায় হচ্ছে আমার মতো করে কাজ করে যাওয়া। তুমি বলেছ এর কী অর্থ? জম্মেছি মরে যাবো। আজ থেকে ধরো, চার থেকে পাঁচ কোটি বছর পর পৃথিবী নামক এই গ্রহটিই থাকবে না। সূর্য নামক নক্ষত্রটি থাকবে না। তাহলে কিসের অর্থ?

রাজু : রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আপনি এক জায়গায় বলেছেন যে, ‘তার পিতা বহু দেবতাবাদী ধর্ম ছেড়ে একদেবতাবাদী পরম সত্তায় বিশ্বাস না আনলে, তার পরিবার ঐ একক পরম সত্তার স্তবে মুখর না হলে, তিনিও থেকে যেতেন বহু দেবতাবাদী।'এটা কি বলা সম্ভব? কারণ আপনি তো কোন দেবতা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। আপনার বাবাও কি তাই ছিলেন? উনিও কি বিশ্বাস করতেন না?

হুমায়ুন আজাদ : রবীন্দ্রনাথের সাথে পার্থক্য আছে আমার। রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে বিশ্বাসী মানুষ। তিনি ঐ প্রচলিত বা পারিবারিক ব্যাপারটিকে প্রত্যাখ্যান করে অন্য একটি বিশ্বাসে যাবেন-এমন মানুষ নন। বরং তার পরিবার যে সমস্ত বিশ্বাস পোষণ করতো না কিন্তু হিন্দুরা করতো, সে রকম দু একটিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। যেমন তিনি খুব আবেগ জাগানো একটি প্রবন্ধে সতীদাহের সৌন্দর্যকীর্তন করেছেন।

রাজু : সতীদাহে? খুবই অবাক ব্যাপার।

হুমায়ুন আজাদ : রবীন্দ্রনাথ সতীদাহের প্রতিও মোহগ্রস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রভুবিষয়ক গানগুলো ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের প্রভুবিষয়ক গানের মতো। অবিশ্বাস করার কোন শক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলো না। তিনি সবকিছুতেই বিশ্বাস করতেন। আর আমার পারিবারিক ব্যাপারটি যেহেতু এসেই গেছে, যেমন আমার বাবা জন্মসূত্রে মুসলমান কিন্তু...

রাজু : জন্মসূত্রে তো আপনিও মুসলমান।

হুমায়ুন আজাদ : আমি বাবার সূত্রে মুসলমান।

রাজু : জন্মসূত্রে না?

হুমায়ুন আজাদ : একই কথা। এই ব্যাপারে আর যেতে চাই না।

রাজু : আপনি মুসলমান কিনা?

হুমায়ুন আজাদ : আমার পরিবার অর্থাৎ পিতামাতা মুসলমান। আমি সেই পরিবারে জন্ম নিয়েছি।

রাজু : তাহলে আপনাকে কী বলবো?

হুমায়ুন আজাদ : আমাকে কিছু বলার দরকার নেই। যে ব্যাপারটিতে আমি আসছি...

রাজু : আপনাকে তো আমরা চিনি হুমায়ুন আজাদ নামে।

হুমায়ুন আজাদ : আমার মুসলমান পরিচিতির কোন প্রয়োজন নেই।

রাজু : কিন্তু মুসলিম একটা নাম তো আছে আপনার সঙ্গে।

হুমায়ুন আজাদ : তুমি বুঝতে পারছো না। মুসলমানদের নাম আরবি ফারসিতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আরবে, ইরাকে, প্যালেস্টাইনে খ্রিস্টান এবং ইহুদির নাম আরবি ভাষায়। এমনকি সাদ্দামের মন্ত্রী তারিক আজিজ, সে মুসলমান নয়; খ্রিস্টান এবং এই অঞ্চলে খলীল জীবরানকে নিয়ে কিছু নির্বোধ খুব মাতামাতি করেছিলো। তারা ভেবেছিলো এই কবি বুঝি মুসলমান। আমি বাবাকে আমি বাবাকে বুড়ো বয়স পর্যন্ত দেখেছি, ধর্ম নিয়ে তার কোন মাতামাতি ছিলো না। নামাজটামাজ এমনিতেই আমাদের এলাকায় বেশি পড়া হতো না আর বুড়ো বয়সে তিনি নামাজ পড়েছেন কিনা জানি না। শুধু এইটুকু মনে আছে তিনি যখন মারা গেলেন তখন তাকে কবরস্থ করা হয়েছে গ্রামে, দুপুরের পরে। তখন নানা রকম পোশাক পরা মলানা যিনি জানাজা পড়াবেন তিনি একটা হিসাব দাখিল করলেন বাবার অপরাধের জন্য কতো টাকা জরিমানা দিতে হবে। প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার মতো।

রাজু : কী অপরাধে?

হুমায়ুন আজাদ : অর্থাৎ নামাজ পড়েননি। এটাকে বোধহয় কাফফারা বলা হয়। আমি মাওলানাকে বললাম এই দিকে আসুন। বললাম হিসাবটা কী? উনি বললেন, পাঁচ লক্ষ টাকার মতো। আমি বললাম আপনার কাজ হচ্ছে জানাজা পড়ানো। আপনি পড়ান। হিসাবতা আমি যেখানে দেয়ার সেখানে দেবো।

রাজু : পরকালে?

হুমায়ুন আজাদ : হাঃ হাঃ। মওলানা তাড়াতাড়ি গিয়ে জানাজা পড়িয়েছে। তারপরে চল্লিশ দিনের অনুষ্ঠান তাতে তিনি এসে আমার কাছে অনেকটা ক্ষমাই চেয়েছেন।

রাজু : তিনি বোধহয় ইতোমধ্যে খোজখবর নিয়ে দেখলেন যে আপনি একজন শক্তিশালী লেখক।

হুমায়ুন আজাদ : না। পরে জানা গেলো মওলানা আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হয়, চার দিনের দিন যে অনুষ্ঠান হয় সেখানে সে ভয়ে আসেনি।

রাজু : ভয় কাটতে একটু সময় লাগে তো। আপনাকে স্যার অনেকেই ভয় পায় দেখছি।

হুমায়ুন আজাদ : তুমি ভয় পাও না দেখতে পাচ্ছি। হাঃ হাঃ ।

রাজু : অনেকে বলে আপনার মুখটা নাকি বিষাক্ত।

হুমায়ুন আজাদ : না, তা নয়। সত্যবাদীকে ভয় পায় লোকজন। এখানে স্যাকারিন মুখগুলো প্রিয়। সত্য চিরদিনই অপ্রীতিকর। মিথ্যা চিরকালই স্যাকারিন মাখা, অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু পরিণামে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

রাজু : তাহলে ছফা ভাই যে আপনাকে সজারুর মতো বলছে, সেটা তাহলে ঠিকই আছে।

হুমায়ুন আজাদ : ও জন্তু-জানোয়ার নিয়ে আছে। ওকে ওসব নিয়ে থাকতে দাও। আমি সজারু হলে সে যে কী জন্তু সেটি তাকে ভেবে নির্বাচন করতে দাও।

রাজু : আমার মনে হয় সজারু আপনাকে খারাপ অর্থে বলে নাই, ভালোই বলছে।

হুমায়ুন আজাদ : তুমি এ নিয়ে তৃপ্ত থাকো। আমার এতে কিছু যায় আসে না, কত রকম তিরস্কার মহাপুরুষেরা সহ্য করে গেছে। তুমি তো জান প্রতিটি মহাপুরুষ কত নির্যাতন ভোগ করেছে। আমার তো এখনও গলাকাটা হয়নি, আমাকে এখনও গ্যালিলিওর অবস্থায় পৌছে দেয়া হয়নি । ব্রুনোর অবস্থা আমার হয়নি। হবে না এমন নয়। তুমি অজস্র তিরস্কারকে..

রাজু : পুরস্কার হিসেবে নিতে হবে?

হুমায়ুন আজাদ : সৌন্দর্যে রূপান্তরিত করে নিতে হবে ।

রাজু : ঐতো, স্যার, পুরস্কার আর কি!

আজাদ : পুরস্কারে আমি বিশ্বাস করি না।

রাজু : বাংলা একাডেমীর পুরস্কার আপনি নেন নাই?

হুমায়ুন আজাদ : বাংলা একাডেমীর পুরস্কার যে বছর আমাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সে বছর পুরস্কার দেয়া হয়নি। দ্বিতীয় বছর যখন একই সিদ্ধান্ত হয়, তখন পুরস্কারটি দেয়া হয়েছে। আমি নিয়েছিলাম। কারণ দু'একটি পুরস্কার না নিলে লোককজন আবার ভাববে কোন পুরস্কারই পায়নি, তাহলে সে লেখকই নয়। তারপর অবশ্য পুরস্কারের ঐ টাকা দিয়ে একটি টেলিভিশন কিনেছিলাম যেটি এক মাস পরে চুরি হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন জীবনপঞ্জী চায় তাতে একটি ঘর থাকে আমি ওটা পূরণ করি না। আমি লিখে দেই উল্লেখযোগ্য নয়।

রাজু : নোবেল পুরস্কার পেলে কি উল্লেখ করবেন?

হুমায়ুন আজাদ : এখন আর কোন পুরস্কারই আমাকে আলোড়িত করে না। নোবেল পুরস্কারও আমাকে আলোড়িত করে না। পৃথিবীতে বহু গৌণ লেখক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। এই যে আমাদের অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। আমি মাঝেমধ্যে হাসি : বেশ ভালো ছেলে, নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। বেশ ভালো।

রাজু : ছেলে?

হুমায়ুন আজাদ : হ্যাঁ। ছেলে, বেশ ভালো। তবে যে তত্ত্ব... ওই বইপত্র তো আমি পড়িনি। যে তত্ত্বটি আমি পত্রপত্রিকায় পড়েছি তা আমার মা বহু বহু বছর আগে জানতো যে আকাল কেন হয়। এটি আমার মাও জানতেন। সবচেয়ে মজা হচ্ছে এই আকালের অর্থনীতিবিদ কিন্তু চিরকাল প্রাচুর্যের দেশে বাস করে গেছে, প্রায় চিরকাল । আরও মজার ব্যাপার বিয়ে নিয়ে যেহেতু তোমরা বেশি বলো, আমি শুনেছি তিনি চার বার বিয়ে করেছেন। তার চেয়ে আমি অবশ্য নবনীতা দেব সেনকে অনেক বেশি প্রতিভাবান মনে করি।

রাজু : তাই কি, স্যার?

হুমায়ুন আজাদ : হ্যাঁ। একটি মজা লক্ষ করবে, আমাদের কপটতার ব্যাপারটাতে। তার ছেলেমেয়ের ছবি ছাপা হয়। কোন স্ত্রীর ছবি ছাপা হয় না। বলতে পারতেন যে এতোগুলো বিবাহ বা একজনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বা তার সঙ্গে আছে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও কী অসহায় অবস্থা।

রাজু : আপনি তো বোধহয় বিয়ে একটাই করেছেন?

হুমায়ুন আজাদ : হাঃ হাঃ। একটায়ই সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত।

রাজু : বুঝলাম না ।

হুমায়ুন আজাদ : তোমার আর বেশি বোঝার দরকার নেই। অনেক আগে আমি একটা প্রবচন লিখেছিলাম যে মহান সলোমনের পাঁচ হাজার স্ত্রী এবং উপপত্নী ছিলো। আমার স্ত্রী একটি। কিন্তু আমার চরিত্র সম্পর্কে সবাই সন্দেহ পোষণ করে। সলোমনকে নিয়ে কারো কোন উদ্বেগ নেই।

রাজু : বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আপনার আছে বলে শোনা যায়।

হুমায়ুন আজাদ : তুমি এ নিয়ে পরে লিখো। যদি শুনে থাক.।

রাজু : আপনি বললে তো আর আমার লিখতে হয় না।

হুমায়ুন আজাদ : আমার কথা যদি তুমি শুনে থাকো তাহলে তুমি এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে পরে আইনসম্মত উপায়ে লেখ।

রাজু : মামলা করবেন?

হুমায়ুন আজাদ : তুমি ওগুলো সংগ্রহ করতে থাকো।

রাজু : স্যার, এমনিতে আছে কিনা?

হুমায়ুন আজাদ : তুমি অনুসন্ধান করতে থাকো। তুমি তো সাংবাদিক এক অর্থে। সাহিত্য সাংবাদিক যদিও।

রাজু : ঠিক আছে, এটা বাদ দিচ্ছি। প্রেম তো আছে বোধহয়।

হুমায়ুন আজাদ : এসব খুব হলদে এবং নিম্নমানের প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে।

রাজু : না, এটা প্রথাবিরোধী হচ্ছে।

হুমায়ুন আজাদ : না, তুমি প্রথাও বুঝে উঠতে পারছো না, প্রথাবিরোধিতাও বুঝে উঠতে পারছো না।

রাজু: আমি যদি জিজ্ঞেস করতাম কার কার সাথে আপনার যৌন সম্পর্ক আছে, সেটা কি প্রথাবিরোধী হতো?

হুমায়ুন আজাদ : না, আমি যখন প্রথাবিরোধিতার কথা বলি, তখন চিন্তার প্রথাবিরোধিতার কথা বলি । এই ব্যাপারটি কেউ বোঝে না, ধরো, আমার অবিশ্বাস হচ্ছে প্রথাগত চিন্তা থেকে সরে আসা, প্রথাগত চিন্তার ক্রটি এবং কপটতাকে দেখিয়ে দেয়া। আমাদের এখানে তুচ্ছ বিষয়কে প্রথাবিরোধী বলা হচ্ছে। তাহলে তো এরশাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রথাবিরোধী।

রাজু : কোন অর্থে?

হুমায়ুন আজাদ : বিয়ে এবং পরস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক। প্রথাবিরোধী নয় এমন অনেকের পরস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচুর্যপূর্ণ।

হুমায়ুন আজাদ : এটা আপনি কার দিকে ইঙ্গিত করলেন?

হুমায়ুন আজাদ : অনেকের দিকেই।

রাজু : অনেকের দিকে মানে পঞ্চাশ-ষাটের লেখকদের প্রাতি?

হুমায়ুন আজাদ : শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত ক্ষেত্রেই। দেখবে, একজন বিচারপতির বউকে নিয়ে গেছে একজন জেনারেল। তোষণে খুব প্রথাবিরোধী এক আমলা ভাগিয়ে নিয়েছে আরেকজনের বউকে। দুজনই খুব প্রথাবিরোধী। প্রথাবিরোধিতা এতো তুচ্ছ ব্যাপার নয়। যে চিন্তার প্রথার মধ্যে আমরা বাস করছি সেই চিন্তাকে গ্রহণ না করা এর বিরোধিতা করা। যেমন আমি কোন কিছু নিয়ে শ্লোগানে মেতে উঠি না। এখানকার লেখকরা তেরেসাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পাগল হয়ে যায়। রাজনৈতিক মহাপুরুষদের নিয়ে এখানকার সব পদ্যকার পদ্য লিখেছে, আমি লিখিনি। আমি ঐ রাজনীতিবিদদের স্লোগানদাতা বা স্তবকারী নই।

রাজু : সুফিয়া কামাল সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?

হুমায়ুন আজাদ : সুফিয়া কামালের সাহিত্যের আমি মূল্য দেই না। কারণ তা মূল্যবান নয়। এবং আমার মানদণ্ডে তিনি কবিই নন। এটা ব্যক্তিগত মূল্যায়ন নয়, এটা তার কাব্য মূল্যায়ন । পাঠ্যপুস্তকে ছাপা হলেই কেউ কবি হয়ে যায় না।

রাজু : বাংলা ভাষায় আমাদের যেসব লেখিকা আছেন তাদের মধ্যে কাকে কাকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়? কিংবা মনে না হলেও বলতে পারেন।

হুমায়ুন আজাদ : আমি ঠিক প্রশংসাপত্র দেয়ায় অভ্যস্ত নই। তুমি যদি প্রশংসাপত্র চাও তাহলে এখানে সত্তর-আশি বছরের বুড়োরা রয়েছে যারা নিয়মিত প্রশংসাপত্র বিতরণ করে চলছে। তাদের কাছে যেতে পার।

রাজু: আমি কিন্তু প্রশংসাপত্র চাওয়ার জন্য প্রশ্ন করিনি। কারণ আপনি তো আর আমার প্রশংসা করছেন না। আমি জানতে চেয়েছিলাম বাংলা ভাষায় আপনার দৃষ্টিতে আদৌ কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা আছেন কিনা?

হুমায়ুন আজাদ : তুমি কি বাংলাদেশের বাংলা ভাষার কথা বলছো?

রাজু : উভয় দেশেরই বাংলা ভাষা হতে পারে এবং মৃত থেকে জীবিত পর্যন্ত ।

হুমায়ুন আজাদ : সবাই বেগম রোকেয়ার কথা বলে । বেগম রোকেয়ার প্রথাবিরোধী কিছু প্রবন্ধ রয়েছে। কিন্তু তিনি-বলা যাক-উৎকৃষ্ট সৃষ্টিশীল লেখিকা ছিলেন না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথাবিরোধী প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। আর পরে বেশ কয়েকজন মহিলা লেখিকা রয়েছেন, সবার নাম হয়তো এই মুহূর্তে মনে পড়বে না। ষাট দশক থেকে আমাদের মহিলা লেখিকারা উল্লেখ করার মতো কাজ করেছেন। যেমন ধরো সুরাইয়া খানম-এর চমৎকার কবিতা রয়েছে। সেলিনা হোসেনও কোন কোন উপন্যাসে বেশ ভালোই করেছেন। আর তাদের চেয়ে বয়স কম, যেমন তসলিমা কয়েকটি চমৎকার কবিতা লিখেছে। তারপর সৃষ্টিশীলতা এবং মননশীলতা দুটো মিলিয়ে ভালো কাজ করেছে ড. আকিমুন রহমান।

রাজু : পশ্চিমবঙ্গে?

হুমায়ুন আজাদ : আমার কোন ভাবনা নেই, ওদের ভাবনা ওদের ভাবতে দাও।

রাজু : পাঠক হিসেবে আপনার কী ভাবনা?

হুমায়ুন আজাদ : প্রথাগত ধারার ভালো উপন্যাস এবং ছোটগল্প লিখেছেন আশাপূর্ণা দেবী। পরবর্তীদের মধ্যে মননশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা মিশিয়ে উল্লেখ করার মত কাজ করেছেন নবনীতা দেব সেন, কেতকী কুশারী ডাইসন।

রাজু : যার সাথে আপনার সংঘর্ষ হয়েছিলো?

হুমায়ুন আজাদ : সংঘর্ষ ঠিক নয়। সে এসে আমার উপর পড়েছিলো । মহাশ্বেতা দেবী খুব প্রশংসিত। তবে তাকে আমার অত প্রশংসার যোগ্য বলে মনে হয় না। কবিতার ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলায় আমার একজনকে খুব ভালো মনে হয়েছে, তার নাম সাধনা মুখোপাধ্যায়। অন্য যেগুলো নিয়ে তোমরা মাতামাতি করো ওগুলো কিছু না।

রাজু : না, আমি তো মাতামাতি করি না। (হঠাৎ টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি কী যেন পান করলেন। আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম) কী খাচ্ছেন? পানি না হুইস্কি?

হুমায়ুন আজাদ : এ দুয়ের পার্থক্য বোঝ না, তোমাকে নিয়ে তো মুশকিল। হাঃ হাঃ।

রাজু : এমনিতে আপনার প্রিয় পানীয় কোনটি?

হুমায়ুন আজাদ : পানীয়র মধ্যে পানি আমার পছন্দ শুধু নয় এটি আমার অতি প্রয়োজনীয়। তারপর যখন আমি পানীয় খাওয়ার কথা ভাবি, আমি হুইস্কিও পছন্দ করি । বিয়ারও পছন্দ করি, এবং ওয়াইনও পছন্দ করি। তুমি খেতে পারছো না বলে আমার খুবই মায়া হচ্ছে তোমার জন্যে। তবে তুমি যেহেতু সাংবাদিকতার পেশায় আছো, সে জন্য সম্ভবত তোমাকে এক সময় অ্যাম্বেসিতে অ্যাম্বেসিতে পড়ে থাকতে হবে। শুনেছি আমাদের এখানকার লেখক এবং সাংবাদিকরা নিজেদের বাসায় যতোটা যায় তার চেয়ে বেশি যায় দূতাবাসগুলোতে এবং দূতাবাসগুলো খুব বদমাশ। আমি দু'একবার গিয়ে দেখেছি। তারা সময় দেয় দেড় ঘণ্টা। এই দেড় ঘণ্টার মধ্যে তৃষ্ণার্ত মুসলমান বাঙালির তৃষ্ণা মেটে না। ফলে তারা অল্প সময়ে পেটের মধ্যে বেশি সংগ্রহ করে আনতে চায় উটের মতো যাতে পরে মরুভূমিতে কাজে লাগে। আমি তো সাংবাদিক নই, ফলে বেশি নিমন্ত্রিত হই না। দু'একবার নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে এই বিদেশীদের বদমায়েশি এবং কিপটেমি দেখে ফিরে এসেছি। ওদের ওখানে আর যাওয়া যায় না।

রাজু : পশ্চিমবঙ্গে কি আদৌ কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন জীবিতদের মধ্যে?

হুমায়ুন আজাদ : এক হচ্ছে, প্রশ্নটা বোধ হয় খোঁচা দেয়ার বাসনা থেকে করা হয়েছে। কেউ কেউ ভালো লেখা তো লিখেছে। একেবারে বাতিল করে দিতে হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। তবে কেউ কেউ ব্যবসায় আবার মন দিয়েছে। যেমন সুনীলের কথাই বলা যাক, সুনীল বেশ কিছু ভালো লেখা লিখেছে এবং বিপুল পরিমাণ খারাপ ব্যবসায়ী লেখা লিখেছে, তারপরে শীর্ষেন্দু ভালো লেখা লিখেছে, যেমন ঘুণপোকা, ফজলে আলী আসছে। কিন্তু রাবিশ লিখেছে অনেক যেমন পার্থিব।

রাজু : আমাদের এখানে এমন কোন লেখক আছেন যার লেখা না পড়লে ক্ষতি নেই?

হুমায়ুন আজাদ : হাঃ হাঃ। আমাদের লেখকরা অবশ্য বিশ্বের অন্যসব লেখকদের মধ্যে প্রচার পায় না। আমরা অনেক সময় বিদেশী তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের নাম জানি। অনেক সময় ওদের বইয়ের আকৃতি দেখে মুগ্ধ হই, ভয় পাই।

রাজুঃ আপনার বইয়েরও আকৃতি দেখে ভয় পাই এবং মুগ্ধ হই।

হুমায়ুন আজাদ : দেশে অবশ্য আমার বইয়ের আকৃতি একটু বড়।

রাজুঃ ভীতিকর রীতিমত।

হুমায়ুন আজাদ : সেটা ভয় পাওয়া দরকার। তোমরা তো কিছুতেই ভয় পাও না। ফলে, যেমন এ বছর যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে তার লেখা আমরা কেউ পড়িনি। তাতে করে খুব অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কত গৌণ লেখক রয়েছে।

রাজু : গান তো শোনেন বোধ হয়।

হুমায়ুন আজাদ : গান শুনি না বললেই বোধ হয় ঠিক হয়। এখন শুনি না।

রাজু : একসময় শুনতেন?

হুমায়ুন আজাদ : না। গান শোনার জন্য একেবারে উদাস হয়ে বসে নিয়মিত গান শোনা মুগ্ধ হওয়া আসরে যাওয়া-এগুলো কখনই করিনি। বরং গান যে ঘিনঘিনে হতে পারে তা আবু সায়ীদ আইয়ুবের একটি লেখায় পড়ে জেনেছিলাম। একবার তিনি অসুস্থ, সন্ধ্যার সময় রবীন্দ্রসংগীত শোনেন-এটা দেখে আমি নিজেই অসুস্থ বোধ করা শুরু করলাম। গানের প্রতি তখনই আমার একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হলো। গান শোনা সম্ভবত এই রকম অসুস্থতারই লক্ষণ।

রাজু : চিত্রকলা কি দেখেন?

হুমায়ুন আজাদ : ছবি আমি দেখি । কিন্তু ছবির প্রতিও আমার খুব বেশি আগ্রহ নেই। যদিও প্রধান শিল্পীদের বহু ছবি আমার দেখা আছে, সরাসরি দেখা আছে এবং এককালে আমি চিত্রকলা নিয়ে পড়াশুনাও করেছি। কিন্তু এর প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। চিত্রকলার সাহায্যে তুমি হ্যামলেট লিখতে পারো না, তেমনি থিউরি অব রিলেটিভিটিও লিখতে পারো না। চিত্রকলার সাহায্যে তুমি গীতাঞ্জলিও লিখতে পারো না, তেমনি ইউলিসিসও লিখতে পারো না। মার্কসের দর্শনও লিখতে পারবে না। এটার জন্য ভাষা দরকার হয়। চিত্রকলা মননকে ধারণ করতে পারে না। পিকাসো বহু ছবি এঁকেছে, অসাধারণ বলে গণ্য, তার বিপুল পরিমাণ দাম এবং আমি হাসি কেন একটি ছবির দাম এতো হতে পারে? কী দিয়ে এটি বিচার করা হয়? ৮০ মিলিয়ন যদি একটি ছবির দাম হয়, তাহলে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোনো গোলমাল রয়েছে। হার্বাট রিড একটি চমৎকার গল্প বলেছেন এ নিয়ে। ছবি যারা সংগ্রহ করে তারা ছবি বোঝে না । রিডের এক বান্ধবী দামি দামি ছবি কিনে ঘর সাজিয়ে রেখেছে। রিড গিয়ে দেখেন সিঁড়ির দেয়ালে একটি পিকাসোর স্কেচ ঝুলছে। বান্ধবীকে তিনি বললেন, এটা তো পিকাসোর একটি অরিজিন্যাল, আপনি এখানে রেখেছেন। তারপরের দিনই দেখা গেলো মহিলা সেটি তার প্রধান প্রদর্শনীশালার সবচেয়ে ভালো জায়গায় রেখেছেন। চিত্রকলা বোবা। যতোই আমরা একে আন্তর্জাতিক বলি না কেন। এ দিয়ে নিশ্চয় আমি আমার অবিশ্বাস লিখতে পারি না।

রাজু : আপনি কি আমাদের এখানকার উপন্যাস পড়েন?

হুমায়ুন আজাদ : এখন নিয়মিত পড়ি বলা ঠিক হবে না । আমাদের এখানকার উপন্যাস মাদেরই মানের অনেকটা। খুব মহৎ উপন্যাস এখানে লেখা হয়নি। আমি শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী এবং আরও অনেকের উপন্যাস পড়েছি। এদের আমি পরিমাপও করেছি এরা কে কোন মাপের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যে মত্ততা এটা নিতান্তই মত্ততা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন দ্বিতীয় মানের লেখক, তার উপন্যাসের মধ্যে ঐ লালসালুই ভালো আর যে দুটি রয়েছে চাদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদো এ দু’টি ব্যর্থ চেষ্টা। এখানকার অবোধ সমালোচকরা এগুলো নিয়ে প্রচুর মাতামাতি করে। তারা অস্তিত্ববাদ বোঝে না। এবং মজা হচ্ছে চাঁদের অমাবস্যাকে এখানে অস্তিত্ববাদের উপন্যাস বলে ঝাড়াঝাড়া আলোচনা করা হয় । কিন্তু চাঁদের অমাবস্যা প্রকাশ করার জন্য তিনি পাঠিয়েছিলেন একটি রহস্য গল্প হিসেবে। পরে রহস গল্প কথাটি বাদ দেয়া হয়, এবং এটি একটি অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হয়ে ওঠে। হাঃ হাঃ। ব্যাপারটি বোঝ। এটি একটি খুনের গল্প মাত্র। তবে ওঁর ছোট গল্প ভালো।

রাজু : আপনি তো অনেকগুলো সরকারের আমল পেরিয়ে এলেন। কোন আমলটি আপনার জন্য সবচে’ নিপীড়ক হয়েছিলো?

হুমায়ুন আজাদ : আমার জন্য কোন সরকারের আমলই শারীরিকভাবে নিপীডক হয়ে ওঠেনি। তবে যদি আমি সেই পাকিস্তান পর্ব থেকে ধরি, ষাটের দশক ছিলো আইয়ুব খানের স্বৈরাচারের দশক। সেই দশকটি ছিলো বাঙালির উত্থানের দশক। এই অঞ্চলে আধুনিক শিল্পকলা বিকাশের দশক । পঞ্চাশে কিন্তু এটি তেমনভাবে শুরু হয়নি। আমার মনে হয় এটাই বাঙালির জন্য শ্রেষ্ঠ দশক যার সর্বোচ্চ সাফল্য '৭১-এ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এর চেয়ে বড় অর্জন তো আর নেই। তারপরে অন্য সবার মতো আমারও সবচে’ ভীতিকর সময় কেটেছে ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর। তার পরে শেখ মুজিবের শাসনকাল যখন ভীতিকর হয়ে উঠেছিলো ক্রমশ ৭৩, ৭৪-এ যখন ভীতিকর হয়ে উঠেছিলো আমি তখন দেশে ছিলাম না। আমি সেই সময়ের রোমহর্ষক বর্ণনা শুনেছি। আমি সেই বর্ণনায় যাবো না। তারপরে যখন দেশে ফিরেছি, তখন সামরিক একনায়ক জিয়ার কাল শুরু হয়ে গেছে এবং জিয়ার কাল ছিলো আমার জন্য মানসিকভাবে নিপীড়নকারী। কারণ জিয়ার শাসনামলে তো আমাদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালানো হতো না। হয়তো মাঝেমধ্যে সামারিক অভ্যুত্থান হতো এবং জিয়া তাদের নিধন করতেন। তারপর এরশাদ পর্ব, এটি একটি দুর্বৃত্তের শাসন। ছাত্রদের ওপর মাঝেমধ্যে ট্রাক চালিয়েছে, কিন্তু আমাদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালাতে পারেনি। বুঝতে হবে, বাংলাদেশী একনায়করাও বাংলাদেশী মাপের। এরা আকারে ছোট। এরা কেউ মুসোলিনী নয়, হিটলার নয়, পিনোশেট নয়, এমনকি পাকিস্তানি জিয়াউল হকও নয়। যদি থাকতে চিলিতে, তাহলে বুঝতে পারতে কাকে বলে সামরিক শাসন। থাকতে বলিভিয়ায় বুঝতে পারতে। আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকরা আমাদের মতো লেখকদের হেলিকপ্টারে করে আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দিয়ে আসা হতো। পরিচছন্নভাবে পরিচছন করা। হাঃ হাঃ হাঃ। তারপরে এরশাদ পর্ব তো আন্দোলন, বিদ্রোহ এবং রং-তামাশার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। এরশাদ খুব রঙ-তামাশা সৃষ্টি করেছিলো। তারপরে এসেছে খালেদা জিয়ার পর্ব, গণতন্ত্র এলো কিন্তু গণতন্ত্র এসে বরং অস্বস্তি সৃষ্টি করা শুরু করলো। একটি বই নিষিদ্ধ করেছে। এটা আমার ওপর একটি বড় রকমের হস্তক্ষেপ, পীড়ন বলা যেতে পারে। তারপর হাসিনা পর্ব আমার কাছে ভালোও নয়, মন্দও নয়। এ নিয়ে আমি ভাবিই না।

রাজুঃ এই সরকারকে যেহেতু গণতান্ত্রিক বলা হয়, তারা তো আপনার বইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে ।

হুমায়ুন আজাদ : আমি তো আর আওয়ামী লীগের লোক নই, আমি তো আর আওয়ামীলীগের স্লোগান্দাতা নই। আমি তো আওয়ামী লীগের কাছে এ ব্যাপারে আবেদনও করিনি । কাজেই এটা তাদের ব্যাপার। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়তো সাথে সাথে মুক্ত করে দেয়া হত। যেমন আনন্দবাজারিদের ক্ষমতা আছে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সম্ভবত তিন দিনের মধ্যে দেশ পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

রাজু : তাহলে আপনার উপর থেকেও তো প্রত্যাহার করা উচিত। নারী হয়ে অন্য ‘নারী’র স্বাধীনতা হরণ করা ঠিক না।

হুমায়ুন আজাদ : সেটা তুমি মনে করলে তো বেশ ভালো। তুমি হাসিনার সঙ্গে বা যোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ কর।

রাজু : সম্প্রতি কবি শামসুর রাহমানকে ‘কবিশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার কোন প্রতিক্রিয়া আছে কি?

হুমায়ুন আজাদ : এত ছোট একটা উপাধি দেয়া হলো শামসুর রাহমানকে। তাকে এমনভাবে অপমান করলো! শামসুর রাহমানকে আমরা পাঁচশ পাঁচটা উপাধি দিতে পারি। এই মুহূর্তে তাকে উপাধি দিতে পারি কবিকঙ্কন’, ‘কাব্যবিনোদ’, ‘আওমীকবিগুণাকর’, ‘স্লোগান রত্নাকর’। শামসুর রাহমান এত অল্প বয়সে এত দুর্বল হয়ে পড়বেন-আমি ভাবিনি।

প্রকাশকাল : ২৭ নভেম্বর ১৯৯৮
দৈনিক মানবজমিন